(সংকেত: ভূমিকা; বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির পটভূমি; ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব; ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা; স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা; ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ; ছাত্ররাজনীতির অতীত ও বর্তমান; বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির যৌক্তিকইতা; বর্তমান প্রেক্ষাটপটে ছাত্রদের করনীয়; উপসংহার।)
ভূমিকা: বিদ্যা অর্জন করা ছাত্র জীবনের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। পাশাপাশি ছাত্রদের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। আজকের ছাত্রই যেহেতু আগামী দিনের নেতা তাই ছাত্রজীবন নেতৃত্ব গঠনের মূখ্য সময়। এজন্য ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয়। বলিষ্ট নেতৃত্ব গঠনের জন্য ছাত্র রাজনীতির বিকল্প নেই। বাংলাদেশে রাজনীতিতে ছাত্র রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে আছে। ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৯০ এর স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল সামনের সারিতে।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির পটভূমি:বাংলদেশের ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তন হয় বৃটিশদের আগমনের প্রায় ১০০ বছর পরে। বৃটিশদের অত্যাচার অনাচার থেকে মুক্তির জন্য ছাত্ররা বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনেও ছাত্ররা জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭- এর দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ নামক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। এর পর থেকেই ছাত্ররা সাংগঠনিকভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা সাংগঠনিকভাবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছে এই ছাত্ররাই।
ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব: জনদাবী আদায়ে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা অনস্বীর্কায। অন্য কোনো শ্রেণি বা পেশার মানুষ ততটা সংগঠিত হতে পারে না যতটা হতে পারে ছাত্ররা। তারুণ্য নির্ভর তেজোদীপ্ত সংগঠিত ছাত্রদের দৃঢ় আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের মতো স্বৈরশাসকেরও পতন হয়েছে, তেমনি পতন হয়েছে স্বৈরশাসক এরশাদেরও। ছাত্ররা সমাজের সবচেয়ে বড় সচেতন গোষ্ঠী। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনো অন্যায় করলে ছাত্ররাই প্রথমে ফুঁসে উঠে তার প্রতিবাদ জানায়। এজন্যই সুশৃংখলিত এবং সুসংগঠিত ছাত্র রাজনীতি যেকোনো দেশের সার্বিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা:১৯৪৮ সালে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঘোষণা দিলেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” তখনই ছাত্র জনতা এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছাত্ররা ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররা সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। এতে পুলিশ ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় আর শহিদ হন সালাম, রফিক, শফিক, বরকত সহ আরও অনেকেই। আন্দোলন আরো বেগবান হলে পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের কারণেই আমরা পেয়েছি আমাদের মাতৃভাষা।
৬২ এর শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা: ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের ভূমিকা:১৯৬৬ সালের ৬ দফাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী “আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামক একটি মামলা দায়ের করে। এতে প্রধান আসামী করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তখন ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই গণঅভ্যুত্থানের চাপে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পদত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে করা মামলাও প্রত্যহার করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা বিশ্বনন্দিত। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সে দেশের ছাত্র সংগঠন এতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এজন্যই ১৯৭১ সালের ২৫ শে র্মাচের কাল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপরই প্রথম আক্রমন চালিয়েছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। কিন্তু তাতে ছাত্ররা দমে যায়নি বরং গোরিলা যুদ্ধ, সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্তু করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।
১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ: ১৯৮০ এর দশকে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাধঁতে শুরু করে। দীর্ঘ ৯ বছরের মাথায় ছাত্রদের আন্দোলনের তীব্রতায় স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়।
ছাত্ররাজনীতির অতীত ও বর্তমান:ছাত্ররাজনীতির অতীত অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল হলেও বর্তমানে তা আর নেই। বরং বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলো দ্বন্দ্ব-কলহ-সংঘর্ষ,চাদাবাজি,খুন ইত্যাদি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এতে যেমন পড়াশুনার স্বাভাবিক পরিবেশে নষ্ঠ হচ্ছে তেমনি অভিভাবকদের উদ্বিগ্নতাও বেড়ে যাচ্ছে। ২০০২ সালের ১৬ জুন বুয়েটের শিক্ষার্থী সনি মারা যায় ছাত্র সংঘর্ষের ফলে। ২০১১ সালে রাজশাহীতে, ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যার ঘটনা নিষ্ঠুর ছাত্র রাজনীতিরই ফল। অথচ অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা ছাত্র রাজনীতির অনেক গৌরবময় অর্জন দেখতে পাই।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির যৌক্তিকতা:বর্তমান সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের অনৈতিক কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে দেশের জনগণের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। ছাত্ররা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে কেবল তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাই নয় বরং জনগণও এর ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়ছে। নৈতিক আদর্শ এবং জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্য দৃঢ় থাকলে বর্তমান সময়েও ছাত্র রাজনীতির আবশ্যকতা রয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের করণীয়:বর্তমান ছাত্ররাজনীতির প্রতি নেতিবাচক ধারণা দূর করার জন্য ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য তাদেরকে দেশের জন্য কল্যাণকর হয় এমন বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার থাকতে হবে। সন্ত্রাস, নিজেদের মধ্যে মারামারি,চাঁদাবাজি বন্ধ করে নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। রাজনীতিবিদরা যেন ছাত্রদেরকে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
উপসংহার: বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলোই আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ এবং দেশের অস্থিরতার জন্য দায়ী। এজন্য বাস্তবতার নিরীখে ছাত্ররাজনীতির লাগাম টেনে ধরা দরকার। তবে বর্তমানে ছাত্র নেতাদের ঐকান্তিক চেষ্টায় ছাত্ররাজনীতির সেই পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে। এজন্য ছাত্রদেরকে ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ করে জনস্বার্থের কথা মাথায় রেখে রাজনীতি করা উচিত। হীন মানসিকতার রাজনীতিবিদের হাতের ক্রীড়ানক না হয়ে দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্ররাজনীতি করতে হবে।
No comments:
Post a Comment